প্রকাশিত: Tue, Feb 14, 2023 4:39 PM
আপডেট: Fri, Jun 27, 2025 2:15 AM

ভালোবাসার প্রকাশ এবং মতপ্রকাশের স্বাধীনতা

শারফিন শাহ্ : যার ভালোবাসার প্রকাশ যতো বিশ্রী হবে, সে ততো কুৎসিৎ, আর কুৎসিৎ হৃদয় কখনো শান্তিতে থাকতে পারে না, তার কাজই হচ্ছে সবকিছুর বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা উড়ানো। এটাই তার পুঁজি, এটাই তার জ্ঞান। আমার দেশ, আমার সমাজের একটা মূল্যবোধ আছে। আমি যখন সাহিত্য রচনা করবো, প্রেম করবো, রাজনীতি করবো, মতপ্রকাশ করবো, তখন আমাকে মনে রাখতে হবে, আমার মূল্যবোধ যেন অক্ষুণ্ন থাকে। লেখকের স্বাধীনতা রয়েছে, কিন্তু পাঠকেরও গ্রহণ করার নির্ধারিত মানদণ্ড রয়েছে। আমাদের দেশের পাঠকরা এখনও আধুনিকতাই অর্জন করতে পারেননি, সেখানে উত্তরাধুনিক বাঁধভাঙা উচ্ছ্বাস বাতুলতা বৈকি। 

রবীন্দ্রনাথ বুদ্ধদেব বসুকে একবার বলেছিলেন, ‘তুমি তোমার তিথিডোর উপন্যাসে এতো যৌনতার আমদানি করেছ কেন, সাহিত্যে যৌনতার শৈল্পিক ব্যবহার কীভাবে করতে হয় তা মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে শিখে নিও’। মানিকের পুতুলনাচের ইতিকথার শশী-কুসুম অন্তর্জাল আজও পাঠকের প্রথম পছন্দ, এমনকি তিথিডোরের চেয়ে দশগুণ বেশি পছন্দ। এর কারণ, উপন্যাসটিতে রয়েছে যৌনতার পরিমিত ব্যবহার। কেউ চাইলে পুরোপুরি নিজের মতো করে তার সাহিত্য রচনা করতেই পারে, তাতে বাঁধা নেই। কিন্তু মনে রাখতে হবে, নিজের ঘরোয়া বিষয় যেন সরাসরি সাহিত্যে না আসে। গোলাম মুরশিদ তসলিমা নাসরিনের সমালোচনা করে লিখেছেন, ‘তসলিমার পড়াশোনা, বিদ্যাবুদ্ধি যথেষ্ট। কিন্তু সেই বিদ্যাবুদ্ধিতে একপেশে যৌনতা যোগ করে নিজের সবটুকু সম্ভাবনা একঘরে করে ফেলেছেন। ঘরের দরজা বন্ধ করার পর কী হয় তা সবারই জানা, এটা জোরজবরদস্তি করে কাউকে বুঝানোর মানে হচ্ছে নিজের ব্যক্তিত্বের স্থলন’ (নারী, ধর্ম, ইত্যাদি)। 

এ ক্ষেত্রে হুমায়ূন আহমেদের একক কৃতিত্ব হচ্ছে, এই মানুষটি সাহিত্যে কোনোরকম যৌনতার আমদানি না করেও জনপ্রিয়তার শীর্ষবিন্দু স্পর্শ করেছেন। রবীন্দ্রনাথের বেলায়ও একই কথা খাটে। ভালোবাসার শারীরিক প্রকাশের চেয়ে রোমান্টিকতাই তার সবচেয়ে বড় সম্পদ। কেউ আবার রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়ের রবীন্দ্রসাহিত্য রচনা পড়ে ভেবে বসবেন না, রবীন্দ্রনাথ অতোটা বেপরোয়া ছিলেন। রঞ্জন নিজেই বেপরোয়া ছিলেন বলে, রবীন্দ্রনাথকেও তার দলে ভিড়াবার চেষ্টা করেছেন আর কী। 

এমনকি তসলিমা নাসরিন শেষ পর্যন্ত তার এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘প্রেম বলতে আমি রোমান্টিকতাই বুঝি। শরীর একটা ব্যাপার, কিন্তু আগে মনটা তো বুঝতে হবে। আমার খুঁত, আমার ভুল, আমার পাপ, সবকিছু মেনে নিয়ে যে আমাকে চাইবে, তার সঙ্গে যে প্রেম, সেটাই অর্থপূর্ণ ও খাঁটি প্রেম’। তসলিমা নাসরিন যে সত্যিই প্রেমকে সত্যি আন্তরিক অনুভূতির আলোকে দেখেন, তার প্রমাণ, তিনি বলেছেন, তার প্রিয় উপন্যাস দেবদাস। এই উপন্যাস নাকি তাকে বহুবার কাঁদিয়েছে।

জান্নাতুন নাঈম প্রীতির বয়স কম। এই বয়সে বোধবুদ্ধি হারিয়ে ফেলা অস্বীকার কিছু নয়৷ তাকে অনেকেই সমর্থন দেন, কিন্তু আমি সব বিষয়ে সমর্থন দেওয়ার প্রয়োজন মনে করি না। বয়স হলে, জীবনের বহুমুখী অভিজ্ঞতার করাল গ্রাসে পতিত হলে, নিজে থেকেই বুঝতে পারবেন, উগ্র মানসিকতার মোহে আচ্ছন্ন হয়ে কী কী ভুল করেছেন। যেমন করে তসলিমা নাসরিন এখন বুঝতে পারছেন। লেখক: প্রাবন্ধিক ও গবেষক